রবিবার, মে ২৯, ২০১১

ব্যাখ্যান


ব্যাখ্যান
নার্গিস নাহার

তারপর রোদের তেজ আরও একটু বাড়লে পরেই ব্যা ফিরত ঘরে। ওর মা শ্রীমতী ব্যা-মা কচি ঘাসের আর কাঁঠাল পাতার প্রাতরাশ তৈরি করে রাখতেন ওর জন্য। ব্যা ঝর্নার জলে একটা ঝপঝপ পরিস্কার স্নান সেরে, মা-এর হাতে কাটা প্রাতরাশ খেত গব গব করে। তারপর চলে যেত - - - ।ব্যা-জার পণ্ডিতের আখড়ায়। সেখানে ব্যা-কার ছাড়াও আরও অনেক ছাগলছানা আসত। আখড়াটাকে ব্যা-জার পণ্ডিত বলতেন ছাগলছানাদের মন্দির। সেখানে গেলেই ছাগলরা ছাগলের মতো ছাগল, বড় ছাগল আর ভালো ছাগল হতে পারে বলে মনে করা হতো।
এদিকে যতদিন যাচ্ছিল ব্যা-কারও তত ব্যাকুল হয়ে উঠছিল হাতে-কলমে ছাগলামি শেখার দিনগুলোর জন্য। বড় বড় ছাগলদের থেকে সে শুনেছিল যে সেই দিনগুলো সব দারুণ মজার দিন। তখন চলছিল ছাগল নিয়ে যাবতীয় প্রবাদ –প্রবচনের ক্লাস। তারপরে সেসবেরই হাতে-কলমে পাঠ হওয়ার কথা ছিল। তবে সাহিত্যে ছাগলদের স্থাণ নিয়ে ক্লাস হওয়ার পর থেকেই ব্যা ঠিক করেছিল যে ও পাঁড়েজীর ছাগলের মতো সাত হাত দাড়ি রাখবে। কী করে লম্বা দাড়ি রাখবে তা জানার জন্য সেই ক্লাসের পর থেকেই ও দাড়িওলা ছাগলদের আশে-পাশে ঘুর ঘুর করত। কিন্তু সাত হাত কেন সেসব ছাগলদের কারোরই সাত ক্ষুরও দাড়ি ছিল না। যত দিন যাচ্ছিল,ব্যা-কার ততই হতাশ হয়ে পড়ছিল। কেবল নিজেকে ওর সদ্য শেখা ব্যা-চারা শব্দটার নিদর্শন মনে হতে লাগল। তবু আশায় আশায় আখড়ায় যেত, হাতে-কলমে শেখার দিনে যদি কোন উপায় শেখা যায় সাত হাত দাড়ি বানানোর সেই ভেবে।
করেই একদিন ব্যাজার পণ্ডিত ঘোষণা করলেন যে সেদিন ছানারা সবাই ধোপাদের মাঠে যাবে। হাতে-কলমে “ছাগলে কিনা খায়” শেখার জন্য। খুব সাবধানে খেতে হবে ছানাদের। যা খুশি তাই খাওয়া চলবে, কিন্তু ডাণ্ডা খেলেই নম্বর কাটা যাবে।
ধোপার মাঠে পৌঁছেই ব্যা-কার খুব হকচকিয়ে গেল। ভাদ্রমাসের দুপুরে যেন দোলের সকাল চলে এসেছে। হরেক রঙে চারদিক ছেয়ে গেছে। এমন সময় ব্যা-জার পণ্ডিত কাজ শুরু করার সঙ্কেত ব্যা-ধ্বনি দিলেন। ছানারা সব হুটোপুটি করে মেলে রাখা কাপড়ের আনাচে-কানাচে ছুট লাগাল।
ডাণ্ডা থেকে বাঁচতে ব্যা-কার একটা চার থামওয়ালা চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়ালো। দেখল চাঁপা রঙের খসখসে কিন্তু নরম নরম একটা কাপড় ঝুলছে চোখের সামনে। কালক্ষেপ না করে ব্যাকার সেটা মুখে পুরে দিল। কিন্তু ব্যা-জার পণ্ডিতের আগেই একটা দুপেয়ে খুব শোরগোল তুলে ব্যা-কারের দিকে তেড়ে এল। ব্যা-কার কিছু বোঝার আগেই থাম চারটে নড়ে গেল, আর চাঁদোয়া সুদ্ধু চারটে থাম এক ঝটকায় হাম্বা ডাকে পিছিয়ে গিয়ে দিলো ছুট। প্রথম লাফে ব্যা-কারও পিছিয়ে গিয়েছিল। পরে থাম চারটে দৌড় শুরু করতে ব্যা-কার ক্ষুরের ঠোকাঠুকিতে প্রায় কিমা হয়ে যাচ্ছিল আরকি। দম নিতে থাম চারটে যেই একটু দাঁড়াল, ব্যা-কার চাঁদোয়ার তলা থেকে বেরিয়ে এল। তারপর থাম চারটে নিজের মতো চলে গেল। ব্যা-কার ফিরে গেল নিজের ঘরে।
পরদিন আখড়ায় গিয়ে ব্যা-কার শুনল যে আগেরদিনের ক্লাস ভেস্তে গেছে বলে, আবার সেই ক্লাসটাই হবে। যথা সময়ে ছানারা একটা লোকালয়ে এল। যেমন খুশি খাওয়ার পর্ব। অতএব চপের ফেলে দেওয়া ঠোঙা থেকে ঘুগনি চাটা শালপাতা সবের উপরই সমান প্রতিযোগিতা। কিন্তু ব্যা-কারের মাথায় ঘুরছে সেরা ছাগলছানা হওয়ার ফিকির। একদম অন্যরকম খুঁজতে খুঁজতে ও দেখল যে একটা বটগাছ তলায় একটা মানুষ শুয়ে আছে। তার হাঁটু সমান দাড়ি। ব্যা-কার আর লোভ সামলাতে পারল না। কে জানে, অমন লম্বা দাড়িটা খেলে যদি ওরও পাঁড়েজীর ছাগলের মতো লম্বা দাড়ি হয়। ব্যা-কার শুরু করল দাড়ির আগা থেকে চিবোন। ধুলোর মিষ্টি স্বাদ আর কিসের যেন নোনতা স্বাদ মিলে ব্যা-কারের খাবারটা স্বাদুই লাগল। তাই ক্লাস শেষের ব্যা-ধ্বনি হওয়া অবধি ব্যা-কার দাড়িই খেয়ে চলল। ব্যা-কারই সেরা ছাগলছানার শিরোপা পেল।
কিন্তু কদিন পর ওর সারা গায়ে সাংঘাতিক চুলকানি হল। ব্যা-মা ওর সারা গায়ের লোম ন্যাড়া করে দিলেন। পরে ছাক্তার দেখে শুনে বললেন যে মানুষের দাড়ি থেকে ব্যা-কারের গায়ে ছোট ছোট রক্তচোষা পোকা ঢুকেছিল; সেই পোকাগুলো চিবিয়ে খেলে নোনতা লাগে আর সেই পোকাগুলোই যখন গা থেকে রক্ত চুষে খায় তখন গা চুলকোয়।
যা হোক, এত কিছুর পর ব্যা-কারের দাড়ির কত বহর হয়েছিল সে কথা আর জানা যায়নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন